সূর্যোদয় ও চেরিফুলের দেশের দিনলিপি-৭
অবশেষে দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় পর কিয়োতো থেকে স্টেট অফ ইমার্জেন্সি তুলে নেয়া হলো। এপ্রিলের ১৭তারিখ থেকে শুরু হয়েছিল। তখন থেকে বাসায় বসে অফিসের কাজ করি। মে মাসের ২১তারিখ তুলে নেয়ার ঘোষণা এলো। এই মাস অবশ্য পুরোটাই বাসায় থেকে কাজ করব। আপাতত অফিসের সিদ্ধান্ত হচ্ছে জুন থেকে সপ্তাহে ৫দিনের মধ্যে ৩দিন বাসায় আর ২দিন অফিসে কাজ করব। গতকাল চাঁদ দেখা না যাওয়ায় আজ ৩০তম রমজান পূরণ করে আগামীকাল শাওয়ালের প্রথম দিন। আগামীকাল ঈদ এই কথা ইচ্ছে করেই লিখলামনা। কারন যতটুকু শুনেছি করোনার কারনে কিয়োতোতে ঈদের জামাত হবেনা। ইচ্ছে ছিল এই রমজানে কিয়োতো মাসজিদে (কিয়োতো ইসলামিক কালচারাল সেন্টার) তারাবীহ পড়াব কিন্তু সেটা হলোনা। জুমায় যাইনা আজকে দুই মাস হলো। এপ্রিল মাস এমনিতেই মাসজিদ বন্ধের সিদ্ধান্ত ছিল। তার উপর স্টেট অফ ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হলো। কবে যে এই অবস্থার উন্নতি হবে। আল্লাহর কাছে এই অবস্থা থেকে পানাহ চাই। আজ দুপুরে হঠাত খারাপ লাগছিল যে পরিবার পরিজন থেকে এত দূরে ঈদ আসছে আমাদের দুই টোনাটুনির জীবনে। কেউই পাশে নাই। আমার জীবনে আমি একবার ঈদ করেছি দেশের বাইরে কলকাতায়। ২০১৪এর কুরবানীর ঈদ। ভার্সিটি থেকে চেন্নাইয়ে ইয়ুথ লিডারশীপ প্রোগ্রাম শেষ করে ফেরার সময়। আর বাকি সব হয় নানুবাড়িতে নয় নিজের ফ্যামিলির সাথে। জাপানে আসার পর থেকে অনেকটাই ঘরকুনো হয়ে গেছি। অফিস, বাসা, অফিস এই চক্রে আবদ্ধ জীবন। অথচ বাংলাদেশে থাকতে আমি ছিলাম বিপরীত। আমার বিশাল বড় পরিচিত পরিমন্ডল ছিল। রাহনুমা তো মাঝে মাঝে বলত, তুমি এত্ত মানুষকে মনে রাখ কীভাবে? দেখা গেল ধানমন্ডি ৩২ এর এবি বিল্ডিং থেকে বের হলাম ২৭ এ ডিটি৫ এ যাব। পথে এট লিস্ট ৫-৭জনের সাথে কুশল বিনিময় তো হতই। একসময় আসহাবে কাহাফের (সাবেক কওমী গ্রুপ) এডমিন থাকার সুবাদে অনলাইনেও ছিল বিশাল পরিচিত সার্কেল। নিজের শহরে তো ছিলই। আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। একদিক দিয়ে এই বিচ্ছিন্নতা উপভোগ করি। নিরবিচ্ছিন্ন জীবন। এখন নিয়মিত যোগাযোগ নিজের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ির সাথেই। তার বাইরে অন্যদের সাথে যোগাযোগের খুব একটা সময়ও পাইনা। তবে মাঝে মাঝে মিস করি সেই নেটওয়ার্কিংময় জীবন। অভ্যাস তো তাই। আব্বু আমাকে প্রায়ই উপদেশ দিতেন আমার এত বড় সার্কেল দেখে। “যার যত বেশি বন্ধু তার তত বেশি শত্রু” বলে। তবে আল্লাহর রহমতে কেন জানি আমি যেখানেই গেছি সেখানেই মানুষের ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই পাইনি। প্রত্যেকটা জায়গায়, প্রত্যেকটা দেশে এই ভালোবাসা আমি পেয়েছি। এই জাপানে এসেও যে ক’জনের সাথে পরিচয় হয়েছে তাদের কাছ থেকে ভালোবাসা আর ভালো ব্যবহারই পেয়ে যাচ্ছি। কেউ একজনের লেখায় পড়েছিলাম যে, মানুষের এই ভালোবাসাটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে কাইন্ড অফ রিজিক। নিজের আমল তো ভালোনা যে দাবী করব আমলের জন্য আল্লাহ মানুষের ভালোবাসা দেন। উল্টো নিজের আমল নিয়ে হতাশ। কী শিখেছি আর কী করছি.. এটা বরং আমার প্রতি তার অতিরিক্ত দয়া। এই দয়ার হক আদায় করার সামর্থ্য যেন হয় সেই তাওফিক্ব আল্লাহর কাছে চাই। আমার জীবনে রমজানের বরকতের একটা প্রভাব আছে সেটা অনুভব করি। কারন জন্ম হয়েছিল রমজানের ২৩তারিখ শনিবারে। মে মাসেরও ২৩তারিখ ছিল। এই বছরে আমার জন্য কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে দু’টো ২৩তারিখেই শনিবার পড়েছে। জাপানে রমজানের ২৩ছিল গত শনিবার আর মে মাসের ২৩ আজকে শনিবার।
মে ২৩, ২০২০ (কিতা-কু, কিয়োতো)