সূর্যোদয়ের দেশের দিনলিপি-১

যদ্দুর মনে পড়ে ছোটবেলায় আম্মুর কাছ থেকে শেখা সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নগুলোর মাঝে প্রথমদিকেই ছিল “কোন দেশকে সূর্যোদয়ের দেশ বলা হয়?”। তখন থেকেই দেশটাকে দেখার প্রবল ইচ্ছে ছিল। পরবর্তীতে সাথে যুক্ত হয়েছিল হিরোশিমা-নাগাসাকি শহর দুইটাকে দেখার ইচ্ছে। গত বছর হঠাৎ করেই জাপানীজ একটা কোম্পানীতে আমার জব হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ অপেক্ষা এবং ভাষা শিক্ষার পালা। কারন সার্টিফিকেট অফ এলিজিবিলিটি (ভিসা পাওয়ার অন্যতম কাগজ যেটা জাপানের মিনিস্ট্রি অফ জাস্টিস থেকে দেয়া হয়) পাওয়ার শর্ত ছিল N4লেভেলের জাপানীজ দক্ষতা দেখাতে হবে। শেষ পর্যন্ত এই বছরের ৩১শে অগাস্ট হাতে পেলাম সিওই। তারপর ভিসার জন্য এপ্লাই করলাম ২তারিখ। ৯ তারিখ ভিসা পেলাম, ১১তারিখ ফ্লাইট। শেষ দিকে এত দৌড়াদৌড়ি হয়েছিল এই মিনিস্ট্রি, ওই মিনিস্ট্রি, শপিং এ; আমার কাঁধের চামড়ায় ক্ষত হয়ে গিয়েছিল ঘামে ভেজা কাঁধে ব্যাগের স্ট্র্যাপ ঘষা খেতে খেতে। তাড়াহুড়ার কারনে কারো কাছ থেকেই আসলে ওরকমভাবে বিদায় নিয়ে আসতে পারিনি। ৯ তারিখেই হাতে ভিসা আর টিকেট পেয়েছি। সো এর আগ পর্যন্ত নিশ্চিতও ছিলামনা যে যাচ্ছি। আর আমার নেটওয়ার্ক আল্লাহর রহমতে এত বড় যে যদি সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে যাই তাহলে এট লিস্ট এক সপ্তাহ লাগবে বিদায় নিতে। তাই আশেপাশে যারা ছিল তারা ছাড়া কারো কাছ থেকেই আসলে বিদায় নেয়া হয়নি। আমার ছোট খালু, বড় খালা, ইভেন আমার শ্বশুর (যিনি হজ্বে ছিলেন) তাদেরকেও ফোন দেয়া হয়নি। অনেকেই রাগও করেছেন বিদাইয় নিইনি বলে। এই পোস্টের মাধ্যমে বিদায় এবং ক্ষমা দু’টোই চেয়ে নিলাম। “সূর্যোদয়ের দেশ” কথাটির তাৎপর্য রক্ষা করতেই হয়তো ১২তারিখ সকালে প্লেনের জানালা দিয়ে প্রথম সূর্যোদয় দেখে শুরু হলো আমার জাপানের জীবন। ছবি যদিও আমার সহকর্মী হেলাল ভাইয়ের ফোনে ছিল কিন্তু আইফোন রিসেট সংক্রান্ত ঝামেলায় এখন দেয়া গেলনা।
তো জাপানীজরা হচ্ছে কাজপাগল জাতি। কাজকে এরা দেবতাজ্ঞানে সম্মান করে। বাইরে থেকে শুনে এসেছি রোবট যেমন এখানে তৈরি হয় তেমনি মানুষগুলাও রোবটের মতই। মানুষে মানুষে আন্তরিকতা কম। আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। বাস্তবে ভেতরে মানবিকতা কতটুকু আছে সেটা আরো দিন গেলে বুঝতে পারব। এমনিতে হেল্প চাইলে পাওয়া যায় আর কার্টেসির বেলায় একেকজন তো সেইরকম সজ্জন। সময়ের ব্যাপারে খুবই সেন্সেটিভ। অফিস শুরু ৯টায় কিন্তু ৮ঃ৩০টাতেই মানুষ এসে উপস্থিত হয়ে যায়। আমরা যেদিন ভোরে ল্যান্ড করলাম সেদিন থেকেই কাজ শুরু। আমার কোম্পানী রিক্রুটদেরকে নিয়ে আসে এভাবে প্ল্যান করেই। বৃহস্পতিবার সকালে জাপানে ল্যান্ড করবে, করার পরই মিউনিসিপ্যালিটি রেজিস্ট্রেশন শেষ করবে আর শেয়ারড হাউজ চিনিয়ে দেবে। অফিসে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেবে। শেয়ারড হাউজে নিয়ে গিয়ে রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস বুঝিয়ে দেবে। শুক্রবার সকালেই আবার অফিস। এদিন ব্যাংক একাউন্ট, নানারকম ফর্ম পূরন ও স্বাক্ষর করাবে। এরপর শনিবার-রবিবার ছুটি। এখানে সাপ্তাহিক ছুটি শনিবার আর রবিবার। জুমার নামাজের জন্য আলাদা ছুটি নাই যদিও কিন্তু কোম্পানী কন্সিডার করে। নরমালি লাঞ্চ আওয়ার ১২টা থেকে ১টা। আমার অফিসে মুসলিমদের জন্য সেটা ১২ঃ৩০টা থেকে ১ঃ৩০টা। কোম্পানী থেকে হাঁটা দূরত্বে শিন-অকুবুর মাসজিদ। ফলে জুমার নামাজটা ওখানে গিয়ে পড়ে আসা যায়। লাঞ্চ করলে সময় নিয়ে একটু টানাটানি পড়ে। তাই চিন্তা করছি বৃহস্পতি-শুক্রবার রোজা রেখে দেব। আর ওয়াক্তের নামাজ অফিস বিল্ডিং এই জায়গা আছে। শিবুয়াতে তুর্কিশ আর্কিটেকচারের একটা মাসজিদ আছে সুন্দর। তুর্কিশরা চালায় সেটা। টোকিওতে সবচেয়ে কনভেনিয়েন্ট বাহন হচ্ছে ট্রেন। সব জায়গা এই ট্রেন দিয়ে কানেক্টেড এবং এক্সাক্ট সময়ে ট্রেনগুলা আসছে আর যাচ্ছে। এমনকি যেখানে যে ট্রেনের দরজা থাকবে বলে প্ল্যাটফর্মে লেখা আছে সেখানেই ট্রেনের দরজা এসে খুলে। আমি থাকি নগাতাতে। নগাতা থেকে শিনজুকু আসা যায় খুব সহজে সেইবু-শিনজুকু লাইনের ট্রেন দিয়ে। বাসা থেকে ১৫মিনিট হেঁটে স্টেশন যেতে হয়, তারপর ২০মিনিট ট্রেন, তারপর আবার ৫মিনিট হাঁটা। এই দেশে হাঁটা ছাড়া গত্যান্তর নাই। এজন্য হয়তো এই দেশের মানুষের শরীরও ভাল থাকে অনেক বয়স পর্যন্ত। বাংলাদেশে তো ১০মিনিটের রাস্তাও যেতাম রিক্সা দিয়ে। আজকে (১৮-০৯-২০১৯) যে ইন্সট্রাক্টর আমাদের বিজনেস ম্যানারের ক্লাস নিলেন তার বয়স ৭৫বছর!! এখনও শক্ত-সমর্থ। এখানে খাবারের হালাল-হারাম নিয়ে সমস্যা। মাঝে মাঝে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে গেলে যখন নাকে এসে খাবারের ঘ্রাণ লাগে তখন পেটে হাহাকার শুরু হয় কিন্তু খাওয়া তো যাবেনা। শিন-অকুবুর এদিকে অনেক হালাল খাবারের দোকান আছে। বাঙ্গালী, ইন্ডিয়ান, তুর্কিশদের দোকান আছে। আজকে দুপুরে শিন-অকুবুর মাসজিদে যোহর পড়ে এক তুর্কিশ দোকান থেকে চিকেন কাবাব র‍্যাপ কিনে নিয়ে আসলাম। খাবার-দাবার অনেক এক্সপেন্সিভ। কাবাব র‍্যাপটা নিয়েছে ৪৫০ইয়েন। বাংলাদেশি টাকায় ৩৪৯.৭৬টাকা। এখানে বড় টমেটো বিক্রি হয় পিস হিসেবে। প্রতি পিস ১০০ইয়েন কোন কোন দোকানে। আবার বাংলাদেশি-ইন্ডিয়ান দোকানগুলাতে বা জাপানীজ সব্জির দোকানগুলোতে একটু বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় অল্প দামে।
এখানকার রেসিডেনশিয়াল এরিয়াগুলা খুবই নিরিবিলি। সন্ধ্যার পর ট্রলি নিয়ে হাঁটলে নিজের কানেই লাগে ঘড়ঘড় শব্দ। আর বাসায় তো নিজের পায়ের আওয়াজই কানে লাগে। এমনিতেই নিশ্চুপ, আরো ফ্লোর হচ্ছে কাঠের প্যানেলিং। ফলে অল্প একটু আওয়াজই কানে লাগে অনেক।
তুর্কিতে থাকতে লিখেছিলাম “তুর্কির দিনলিপি”। ভাবছি এবার জাপানবাস নিয়েও সিরিজ লিখব।
#সূর্যোদয়_ও_চেরিফুলের_দেশের_দিনলিপি

You may also like...